সম্প্রতি মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে, যা বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্কতার ঘণ্টা বাজিয়েছে। মায়ানমারে ৭.৭ মাত্রার এবং থাইল্যান্ডে ৮.২ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে—বহুতল ভবন ধসে পড়েছে, রাস্তাঘাট উপড়ে গেছে, সেতু ভেঙে পড়েছে এবং অবকাঠামোর বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এই ঘটনার পর বাংলাদেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন যে, বাংলাদেশও একই ধরনের বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি, এর কারণ, সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি: বর্তমান পরিস্থিতি :
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে ইন্ডিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মিজ প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে। এই প্লেটগুলোর মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ এবং চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের জন্য দায়ী। বিশেষ করে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল, যেখানে ডাওকি ফল্ট এবং অন্যান্য ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে ১৭৬২ সালে আরাকান-চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প এবং ১৮৮৫ সালে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড সাধারণত ১৫০-২৫০ বছর হয়, এবং এই হিসেবে বাংলাদেশে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।
মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সতর্কতা জারি করে বলেছে যে, বাংলাদেশেও একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং ময়মনসিংহ অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে জনঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং দুর্বল অবকাঠামো ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কেন বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি?
ভূতাত্ত্বিক অবস্থান :
বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকির প্রধান কারণ এর ভূতাত্ত্বিক অবস্থান। সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বার্মিজ প্লেট এবং ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে। এই অঞ্চলে গত ৮০০ থেকে ১০০০ বছর ধরে জমে থাকা শক্তি এখনো মুক্ত হয়নি, যা একটি বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া, ডাওকি ফল্ট, মধুপুর ফল্ট এবং অন্যান্য ফল্টলাইন বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন :
ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে অপরিকল্পিত নগরায়ন ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। ঢাকার সম্প্রসারিত অঞ্চলে জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকাগুলোর মাটি নরম, যা ভূমিকম্পের কম্পনকে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) মেনে অনেক ভবন নির্মাণ করা হয় না, যা ভূমিকম্পের সময় বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
জনঘনত্ব এবং দুর্বল অবকাঠামো :
বাংলাদেশে জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, বিশেষ করে ঢাকায়। এখানে অধিক বহুতল ভবন, সরু গলি, খোলা জায়গার অভাব এবং উদ্ধার সরঞ্জামের সীমিত সুবিধা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দিতে পারে। বুয়েটের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, যার মধ্যে সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ এবং ঢাকার কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য।
মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভূমিকম্প: বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা :
২৮ মার্চ, ২০২৫-এ মায়ানমারে ৭.৭ মাত্রার এবং থাইল্যান্ডে ৮.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এই ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই অঞ্চলগুলো বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থিত এবং একই টেকটোনিক প্লেটের প্রভাবে ভূমিকম্প হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মতে, বাংলাদেশেও একই মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে, যেখানে অপরিকল্পিত ভবন এবং দুর্বল অবকাঠামো রয়েছে, সেখানে ক্ষতি অপরিমেয় হতে পারে।
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি
- ভবন ধস: ঢাকার অনেক ভবন ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নয়। ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বহুতল ভবন ধসে পড়তে পারে, যা ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
- অবকাঠামোর ক্ষতি: রাস্তাঘাট, সেতু, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি হতে পারে, যা উদ্ধার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে।
- সুনামি ঝুঁকি: চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমিকম্পের ফলে সুনামি হতে পারে, যেমনটি ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় দেখা গিয়েছিল।
- মানবিক সংকট: ভূমিকম্পের পর খাদ্য, পানি এবং আশ্রয়ের অভাবে মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়া, মহামারী ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিও বাড়বে।
প্রস্তুতি ও করণীয়
সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে
- ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ: বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ কঠোরভাবে মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর সংস্কার বা রেট্রোফিটিং করা জরুরি।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত মহড়া ও প্রচারণা চালাতে হবে।
- উদ্ধার ব্যবস্থা জোরদার: ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।
- ইউটিলিটি সার্ভিস সুরক্ষিত করা: গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ লাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভূমিকম্পের সময় অগ্নিকাণ্ড বা অন্যান্য দুর্ঘটনা না ঘটে।
ব্যক্তিগত স্তরে
- নিরাপদ আশ্রয়: ভূমিকম্পের সময় ‘ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন’ পদ্ধতি অনুসরণ করুন। অর্থাৎ, মেঝেতে বসে পড়ুন, শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন এবং টেবিল ধরে থাকুন।
- জরুরি কিট প্রস্তুত: পানি, খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম, টর্চলাইট এবং ব্যাটারি সংরক্ষণ করুন।
- জরুরি নম্বর সংরক্ষণ: ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ এবং হাসপাতালের নম্বর হাতের কাছে রাখুন।
- পরিবারের সাথে পরিকল্পনা: ভূমিকম্পের সময় কী করবেন, তা পরিবারের সবাইকে জানিয়ে রাখুন এবং বছরে একবার মহড়া দিন।
উপসংহার :
মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। আমাদের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং দুর্বল অবকাঠামো আমাদের ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। তবে সঠিক প্রস্তুতি এবং সচেতনতার মাধ্যমে আমরা এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারি। সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। আপনি কী মনে করেন? ভূমিকম্পের জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? আপনার মতামত নিচে কমেন্টে জানান!